আমার যা ছিল তা নিয়ে গেল যা নেই তার ক্ষোভে!

[এই পোস্টটা পুরাতন দুইটা পোস্টের সমন্বিত ও সামান্য পরিবর্তিত রূপ। আমাদের নাচোল থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন “প্রস্ফূরন” এর জন্য পাঠালাম। ভাবলাম এখানেও আবার তুলে রাখি।]

এই মুহূর্তে কেউ যদি প্রশ্ন করে দিনকাল কেমন চলছে, কোন কিছু না ভেবেই উত্তর দেব বেশ সুখে আছি। মাঝে মাঝে ২-১ টা না পাওয়া যে নাই তা নয়,তবে সেগুলো খুবই নগণ্য। ছোটখাট না পাওয়াগুলোতো থাকবেই। সেগুলোকে ধর্তব্যের ভেতরে নিলে জীবন চালানো যাবেনা। “ইস! আমার সিজিপিএ যদি আরেকটু বেশি হতো! পরীক্ষা খারাপ হয়েছে মন খারাপ। আজ ১ মার্কসের এন্সার করতে পারিনি। আমার যদি একটা আইপ্যাড থাকতো! একটা গাড়ি কেনার খুব শখ আমার, ঢাকায় একটা বাড়ি না থাকলে কি চলে?” আল্লাহর রহমতে এই টাইপ ইচ্ছা, আকাঙ্খা, আক্ষেপগুলো আমাকে এখন আর স্পর্শ করেনা। মন থেকে বলতে পারি, “এই বেশ ভাল আছি!”

কার কাছে যেন শুনেছিলাম পৃথিবীতে আল্লাহর সবচেয়ে বড় নিয়ামত হচ্ছে “শারীরিক সুস্থ্যতা”। আমারও তাই মনে হয়। আল্লাহ কত কিছু দিয়েছে আমাকে! চোখে চশমা পর্যন্ত ওঠাতে হয়নি আল্লাহর রহমতে। অনেকেরই শুনি মাইগ্রেনের ব্যাথা ইত্যাদি ইত্যাদি। আল্লাহর রহমতে এরকম কিছুতে এখনও ভুগতে হয়নি আমাকে। এইরকম অঢেল নিয়ামত থাকার পরও নিজের ছোটখাট অপ্রাপ্তিতে দুঃখিত হই কিভাবে! হে আল্লাহ তোমাকে মন থেকে ধন্যবাদ শারীরিক সুস্থ্যতার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ।

গত কয়েকদিন আগে ইমরানের পিসিতে ভিডিও দেখলাম একটা। খুব খারাপ লাগলো। একজন লোকের দুটো হাতই নেই। তারপরও সবকিছুই করেন তিনি এবং তিনি সুখী,তাঁর মনে দুঃখ নেই। নামজের জন্য যখন ওযু করছিলেন তখন তার কষ্ট টের পেলাম। একটু ভেবে দেখুন দুই হাত ছাড়া কুলি করা,মুখ ধোয়া, মাথা মসেহ করা কতটা কঠিন। এই কঠিন কাজগুলো নিয়মিত করে চলছেন তিনি। পা দিয়ে মুখ ধোয়ার কাজ ও মাথা মসেহ করেন তিনি। একবার চেষ্টা করে দেখুন তো হাতের কোন রকম সাহায্য ছাড়া পা দিয়ে মুখ মুছতে এবং মাথা মসেহ করতে পারেন কিনা?

এত কষ্টকর হবার পরও তিনি নিয়মিত নামাজ পড়ে যাচ্ছেন,এবং খুশি। আর আমরা? সবকিছু ঠিক আছে শুধুমাত্র কিছু সময় খরচ করে নিয়মিত নামাজ পড়িনা আলসেমী বা অবহেলার কারণে। কাল সকালে যদি আমার দুটো হাত বা দুটো পা অকেজো হয়ে যায়? সারা শরীর না,শুধুমাত্র হাতটা অকেজো হয়ে গেছে ধরে চিন্তা করুন কিছুক্ষনের জন্য। পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার মনে হচ্ছেনা? আর এই আমি আপনিই এখন ছুটে বেড়াচ্ছি যা নাই তার জন্য। যা আছে তার গুরুত্ব নাই আমাদের কাছে।

পরীক্ষায় একটু খারাপ রেজাল্ট করেছি তাই সারাদিন মন খারাপ করে বসে আছি এ প্লাস পেলামনা কেন? আমার জীবনটাই বরবাদ হয়ে গেল। এস.এস.সি. , এইচ.এস.সি. তে খারাপ রেজাল্ট করে আমার লাইফটাই বরবাদ হয়ে গেছে। আমি ভাল জায়গায় ভর্তি হতে পারিনি কেন? হাজার হাজার না পাওয়ার বেদনা এবং আক্ষেপে জীবনকে শেষ করে দিচ্ছি প্রতিনিয়ত!
জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটা কখনো শেষ হয়ে যায়না,যে কোন জায়গা থেকেই সুখী হওয়া যায় যদি আপনার/আমার সুখী হবার মানসিকতা থাকে।কি ছিল আর কি হতে পারতো সেটা নিয়ে না ভেবে, কি আছে এবং সেটা দিয়ে কিভাবে ভাল কিছু করা যায় সেটা নিয়েই ভাবা উচিত। কি পাইনি সেটা বাদ দিয়ে আমি কি কি পেয়েছি সেটার একটা লিস্ট করে দেখি আসুন তো। হাত, পা, চোখ,কান থেকে আরম্ভ করুন এবং ইন্টারনেটে এসে থামুন। আমি ইন্টারনেট পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারছি, এর মানে আমাদের ভেতরও সুখী হবার পর্যাপ্ত উপকরণ আছে! হাস্যকর মনে হচ্ছে? হাসপাতালে চরম বেদনায় কাতর রোগীকে কখনও টেলিভিশন দেখতে দেখেছেন? টেলিভশন, ইন্টারনেট ইত্যাদি মানুষ তখনই ব্যবহার করে বা মানুষের তা ব্যবহারের মানসিকতা থাকে যখন সে সুখে থাকে বা সুখে থাকার পর্যাপ্ত উপকরণ তার হাতে থাকে।

আরেক ধরণের আক্ষেপবাদী বা হতাশাগ্রস্তদের ইদানিং খুব দেখা যায়,“এখন পর্যন্ত একটাও প্রেম করতে পারলাম না, একা একা আর ভাল লাগেনা, গার্লফ্রেণ্ড না থাকলে এটা কোন জীবন হলো, আমার গার্লফ্রেণ্ডটা দেখতে সুন্দর না,ইস আমার যদি একটা সেইরকম গার্লফ্রেণ্ড থাকতো! ও আমারে ছেড়ে চলে গেছে, আমার জীবনটাই বাদ। আমার একদিকে পৃথিবী আর একদিকে শুধু তুমি ব্লা… ব্লা… ব্লা…” । লজ্জা লাগছে? লাগার কিছু নাই। আমরা সাধারণত এরকমই । চোখের সামনে একটা পর্দা টাঙ্গানো আছে। সেই পর্দাটা আমাদের সুখগুলোকে আড়াল করে রাখছে আর সবসময় কুমন্ত্রণা দিচ্ছে তোমার এটা নাই,তোমার ওটা নাই্‌ তোমাকে এটা করতে হবে,ওমুক এটা করে ফেলেছে তুমি কবে করবা?

সুখী হবার জন্য আমাদের বেশি কিছুর দরকার নাই। শুধু দৃষ্টিভঙ্গীটাএকটু পরিবর্তন করা দরকার, আপনার যা আছে তা-ই সুখী হবার জন্য যথেষ্ট। আপনার হাতে ছক্কার মার নাই? সো হোয়াট? চার মারুন। চারের মারও নাই? সিঙ্গেল নিতে থাকুন। প্রতি বলে সিঙ্গেল নিতে থাকলেও কিন্তু ৩০০ রান হয় ৫০ ওভারে। আফসোস, আমরা খালি চার ছক্কার পেছনে ছুটি।

আমাদের অনেকের বড় একটা ভুল হচ্ছে যখন যেটা থাকেনা সেটা নিয়ে বেশি ভাবতে ভাবতে যেটা আছে সেটাকে অবহেলা করি। অথচ যেটা আছে সেটাই সুখী হবার জন্য যথেষ্ট,দরকার শুধু উপযুক্ত পরিচর্যা। শুধু শুধু উচ্চাকাঙ্খা করে মন খারাপ করার চেয়ে যেটা আছে সেটা নিয়ে সুখী হবার চিন্তা করাটা বেশি ভাল। সময় হলে আকাঙ্ক্ষা এমনিই পূরণ হবে,চারপাশ ভুলে আপনি যত বেগে অপূর্ণ উচ্চাকাঙ্খার পেছনে ছুটবেন সুখ তত বেগেই দূরে সরে যাবে আপনার থেকে। কাজেই যা নেই তার ক্ষোভে যা আছে তা হারিয়ে যেতে দেওয়াটা বোকামীর কাজ।

তবে, নিজের কাজ সম্পর্কে উদাসীন হলে চলবেনা, আমার যা আছে তা দিয়েই আমাকে ভাল কিছু করার চেষ্টা করতে হবে। অতিরিক্ত আত্মতুষ্টিও অনেক সময় অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিজের কর্তব্যগুলো ঠিকমত পালন করে ফলাফলটা আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমার কাছে এটাই সুখী হওয়ার সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি বলে মনে হয়। খালি খালি ফলাফল নিয়ে বেশি চিন্তা করতে যেয়ে অনেকে নিজের কাজের সুফলটাও ঠিকমত ভোগ করতে পারেনা।

এবার একটা গল্প বলি-

পানিভর্তি গ্লাস হাতে নিয়ে ক্লাশ আরম্ভ করলেন এক প্রফেসর। হাত দিয়ে গ্লাসটি উঁচু করে ধরে ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন,“এই গ্লাসটির ওজন কত বলতে পার?”
-৫০ গ্রাম…
-১০০ গ্রাম…
-১২৫ গ্রাম…
ছাত্ররা নানা রকম উত্তর দিল।
প্রফেসর বললেন,আসলে ওজন না মেপে এর প্রকৃত ওজন আমি বলতে পারবনা। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে,“আমি যদি এটাকে এভাবেই কয়েক মিনিট ধরে রাখি তাহলে কি হবে?”

ছাত্ররা উত্তর দিল,“কিছুই না”।
প্রফেসর বললেন,“যদি এক ঘন্টা ধরে রাখি?”
ছাত্ররা বললো,“আপনার হাত চুলকাবে”।
প্রফেসর বললেন,“ঠিক বলেছো। আমি যদি সারাদিন এভাবেই ধরে রাখি,তাহলে কি হবে?”
“আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়বেন,আপনার হাত অবশ হয়ে যেতে পারে। আপনার শরীরের ওপর অনেক চাপ পড়বে এবং আপনাকে হাসপাতালে যেতে হবে” ছাত্ররা উত্তর দিল।
“একদম ঠিক। কিন্তু এই সবকিছুর পরেও গ্লাসের ওজনের কি কোন কমবেশি হবে?” প্রফেসর জিজ্ঞাসা করলেন।
ছাত্রদের সমবেত উত্তর, “না”।
“তাহলে কেন আমার হাত চুলকাবে এবং পেশিতে চাপ পড়বে?”, প্রফেসরের প্রশ্ন।
ছাত্ররা অবাক হয়ে বললো,“গ্লাসটি নামিয়ে দিন স্যার”।
প্রফেসর বললো,“আমাদের জীবনের সমস্যাগুলোও অনেকটা এরকমই। অল্প কিছুক্ষন সমস্যার কথা মাথায় রাখলে কোন সমস্যা হবেনা। বেশি সময় সেটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে মাথায় চাপ পড়বে। আরও বেশি সময় সে সমস্যা মাথায় রাখলে তোমার মস্তিষ্কই অচল হয়ে পড়বে এবং তুমি কিছুই করতে পারবেনা।“

▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒

আমাদের জীবনের সমস্যাগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করাটা গুরুত্বপূর্ণ,কিন্তু সবরকম পরিস্থিতিতেই আল্লাহর উপর আস্থা রাখাটা আরও বেশি জরুরী এবং প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে সব ধরনের চিন্তা-ভাবনা মাথা থেকে সরিয়ে রাখতে পারলে ভাল হয়। এটা করতে পারলে আমাদের উপর তেমন বেশি চাপ পড়বেনা । প্রতিদিন সকালে সুস্থ্য সতেজ মন নিয়ে ঘুম থেকে উঠে সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো সুন্দরভাবে মোকাবেলা করতে পারব।

সুতরাং দিনশেষে “গ্লাসটি নামিয়ে রাখুন” এবং আল্লাহ তাআলার উপর বিশ্বাস রাখুন।

▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒

“ তিনি মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল করেন,যাতে তাদের ঈমানের সাথে আরও ঈমান বেড়ে যায়। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের বাহিনীসমূহ আল্লাহরই এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ,প্রজ্ঞাময়।।“ [48:04]

প্রশান্তি দৃঢ় বিশ্বাসের লক্ষন,অস্থিরতা এবং চাপ দূর্বল বিশ্বাসের পরিচায়ক।
প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে আপনার মনকে বলুন-

“হে প্রশান্ত মন,
তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে।
অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও।
এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।“
[ সূরা আল-ফজরঃ ২৭-৩০ ]

▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒▒

3 responses to “আমার যা ছিল তা নিয়ে গেল যা নেই তার ক্ষোভে!

মন্তব্য করুন